ভালো খাদ্যাভ্যাস কেন প্রয়োজন?

ভালো খাদ্যাভ্যাস কেন প্রয়োজন?

ভালো খাদ্যাভ্যাস কেন প্রয়োজন?

সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, ভালো খাদ্যাভ্যাস আমাদের চারপাশে আলোচনা প্রাধান্য পেয়েছে, আমাদের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উপর এর প্রভাব সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করেছে।  ভালো খাদ্যাভ্যাস একজনকে শুধু শারীরিক স্বাস্থ্য ভালো রাখে না মানসিক ভাবে প্রফুল্য রাখে । 

 
ভালো খাদ্যাভ্যাস কী?    
খাদ্যাভ্যাস মুলত খাদ্য গ্রহণের সেই অভ্যাস যার ফলে একজন মানুষ  পরিপূর্ণ সুষম পুষ্টি পেয়ে থাকবে যা অনেক বেশী হবে না আবার অনেক কম হবে না। আমাদের সমাজে একটি ভ্রান্ত ধারনা আছে , একটি চিকন শরীর সুস্থ থাকার সমার্থক, একই  ধারনা করা হয় যে বৃহত্তর দেহের ব্যক্তিরা সহজাতভাবে অস্বাস্থ্যকর। খাদ্যাভ্যাসের এই  নিয়ম অত্যন্ত অসামঞ্জস্যপূর্ণ । অতিরিক্ত খাদ্য মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর তেমনি কম খাদ্য সমানভাবে ক্ষতিকর। আমাদের সবারই উচিত সুষম ও পূষ্টিকর খাদ্য গ্রহন যাতে  পর্যাপ্ত পুষ্টিগুণ বিদ্যমান । 

 

 ভালো খাদ্যাভাস কিভাবে তৈরি হয়ঃ    

খাদ্যাভ্যাস  শুধুমাত্র ওজন কমানোর টিপস এবং খাবার পরিকল্পনা নয়। এটি নিজের উপর বিশ্বাস এবং অনুশীলনের একটি বিস্তৃত প্র্যাকটিস যা সুস্বাস্থ্য হওয়াকে মহিমান্বিত করে । খাদ্য গ্রহণের সাথে জড়িত অপুষ্টি এবং খাদ্য সংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদি রোগের হার কমানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, নিজস্ব খাদ্যাভ্যাসের সাথে মিল রেখে প্রতিটি দেশের একটি খাদ্য গ্রহণ নির্দেশিকা থাকা প্রয়োজন। জাতীয় খাদ্য ও পুষ্টিনীতি এবং বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিকল্পনা ১৯৯৭ এর অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল খাদ্য গ্রহণ নির্দেশিকা প্রকাশ  করা হয় । খাদ্য সংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদি রোগগুলোর মৃত্যুহার অপুষ্টিজনিত মৃত্যুর হারের চেয়ে বহুগুণ বেশি। এজন্য বাংলাদেশ জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষি ও পুষ্টি সংক্রান্ত বিনিয়োগ পরিকল্পনায় (২০১১-২০১৫) এবং জাতীয় পুষ্টিনীতি ২০১৫ তে জাতীয় খাদ্য গ্রহণ নির্দেশিকা প্রকাশকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। এছাড়াও জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতিটি জাতিকে নিজস্ব খাদ্য গ্রহণ নির্দেশিকায় বিশেষ কতগুলো তথ্যযুক্ত করার পরামর্শ দেয়। সাম্প্রতিক খাদ্যের অভাবজনিত অপুষ্টির চিত্র, খাদ্য সংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদি রোগের হার, সাম্প্রতিক খাদ্য গ্রহণের ধরন, এছাড়াও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রকাশিত বিভিন্ন বয়সের খাদ্য উপাদানের চাহিদা, মৌসুমি খাবার এসব অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে বর্তমান খাদ্য উপাদানের চাহিদা, মৌসুমি খাবার অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে বর্তমান খাদ্য নির্দেশনা করা হয়েছে। গবেষণালব্ধ জ্ঞানের ভিত্তিতে প্রণীত খাদ্য গ্রহণ নির্দেশনা উন্নত পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণে সাহায্য করবে। 


আঞ্চলিক খাদ্যাভাসের সাথে খাদ্য বৈচিত্র্যকে প্রাধান্য দেয়া দরকার।মৌলিক খাদ্যগুলো অর্থাৎ ভাত, রুটি, মাছ, মাংস, দুধ ডিম, ডাল, শাকসবজি ও ফলমূল সঠিক পরিমাণে গ্রহণ করতে হবে।খাদ্য গ্রহণ প্রক্রিয়ায় খাদ্য বিনিময় ও পরিবেশনের ওপর গুরুত্ব দেয়া জরুরি। সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য প্রত্যেককে   পরিমিত পরিমাণে খাদ্য গ্রহণকেই প্রাধান্য দেয়া উচিত। 


* প্রতিদিন সুষম ও বৈচিত্র্যপূর্ণ খাদ্য গ্রহণ 
* পরিমিত পরিমাণে তেল ও চর্বিজাতীয় খাদ্য গ্রহণ 
* প্রতিদিন সীমিত পরিমাণে আয়োডিনযুক্ত লবণ গ্রহণ 
* মিষ্টিজাতীয় খাদ্য সীমিত পরিমাণ গ্রহণ 
* প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে নিরাপদ পানি ও পানীয় পান; 
* নিরাপদ খাদ্য গ্রহণ; সুষম খাদ্য গ্রহণের পাশাপাশি নিয়মিত শারীরিক শ্রমের মাধ্যমে আদর্শ ওজন বজায় রাখা; সঠিক পদ্ধতিতে রান্না, সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং সুস্থ জীবনযাপনে নিজেকে অভ্যস্তকরণ

* গর্ভাবস্থায় এবং স্তন্যদানকালে চাহিদা অনুযায়ী বাড়তি খাদ্য গ্রহণ; শিশুকে ৬ মাস বয়স পর্যন্ত শুধু মায়ের দুধ দিন এবং ৬ মাস পর বাড়তি খাদ্য প্রদান।   

 

সুস্থ জীবনযাপনে খাদ্যাভ্যাসঃ   
খাবারের পরপরই ঘুমানোর অভ্যাস বাদ দেয়া এবং সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য দৈনিক ৬-৮ ঘণ্টা সুনিদ্রার অভ্যাস করা; দৈনিক কমপক্ষে ৩০-৪৫ মিনিট শারীরিক পরিশ্রম করা; ধূমপান, মদ্যপান, তামাক এবং সুপারি চিবানোর মতো অভ্যাসগুলো বাদ দেয়া; খাওয়ার আগে, খাওয়ার পরে, রাথরুম ব্যবহারের পরে এবং বাইরে থেকে বাড়িতে ঢুকে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস করা; প্রতি সপ্তাহে একবার নখ কাটা; ২ বছর বয়স থেকে প্রত্যেকে (গর্ভবর্তী মা ব্যতীত) ৬ মাস
পরপর একবার কৃমিনাশক ট্যাবলেট খাবারের পর গ্রহণ করা; বছরে অন্তত একবার পুরো শরীর মেডিকেল চেকআপ করানো আবশ্যকীয়।  
 


নিরাপদ খাদ্য গ্রহণ. 
বাসি, পচা ও দূষিত খাদ্য গ্রহণের ফলে মানুষের মারাত্মক অসুস্থতা এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস এবং ছত্রাকের আক্রমণ খাদ্য ও পানীয়কে বিষাক্ত করে তোলে। ইঁদুর ও বিষাক্ত পোকামাকড় খাদ্যকে অগ্রহণযোগ্য করে তোলে। খাদ্য তৈরিতে নিয়োজিত ব্যক্তির উন্মুক্ত কাটাস্থান ও ক্ষত এবং ব্যক্তিগত অপরিচ্ছন্নতার কারণে খাদ্য দূষিত হয়। ধুলাবালি, মশামাছিও খাদ্যকে দূষিত করে। নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর স্থানে মুরগি ড্রেসিং এর সময় জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। অতিরিক্ত হরমোন প্রয়োগে গরু ও মহিষ মোটাতাজা করা হয়, যা মানব স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ নয়। বাদুড় ও পাখি খেজুর ও তাল গাছের রসকে বিষাক্ত করে ফেলে যা জীবনের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। অনেক সময় জুস, খোলা সরবত ও কোমল পানীয় তৈরিতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার নিয়ম মানা হয় না। যার ফলে খাদ্যবাহিত বিভিন্ন রোগ টাইফয়েড, ডায়রিয়া, আমাশয় এসবে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। এছাড়াও খাদ্যে ভেজাল দ্রব্য মিশ্রণ, অনুমোদনবিহীন ও মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতিকর রঙ ও গন্ধের ব্যবহার করা হয়, যা স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। 


ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ ও রঙ ব্যবহারের মাধ্যমে নষ্ট, বাসি ও নিম্নমানের খাবরকে আকর্ষণীয় করে তোলা হয়। টিনজাত ও প্যাকেটজাত খাদ্যে বিদ্যমান বিভিন্ন কৃত্রিম রাসায়নিক পদার্থ যেমন- টেস্টিং সল্ট, ট্রান্সফ্যাট ছাড়াও অনুমোদনবিহীন ও মাত্রাতিরিক্ত খাদ্য সংযোজন দ্রব্য ব্যবহার করা হয়, যা দেহে স্থূলতা, স্তন ক্যান্সার, প্রোস্টেট ক্যান্সার, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। আমাদের দেশে অধিক মুনাফার জন্য শাকসবজি ও ফলফলাদি মৌসুমের আগে বাজারজাত করার জন্য অননুমোদিত কিংবা মাত্রাতিরিক্ত হরমোন ব্যবহার করার প্রবণতা দেখা যায়। অন্যদিকে শাকসবজি ফলফলাদি, মাছ এসব পচনশীল খাদ্যে ফরমালিনের অপব্যবহার হয়ে থাকে যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। প্রাকৃতিকভাবে পরিপক্ব ফল ও শাকসবজিতেই পুষ্টিগুলো পরিপূর্ণভাবে পাওয়া যায়। খাবার প্রস্তুত ও গ্রহণকালে খাদ্য নির্বাচন, লেবেল, খাদ্য সংরক্ষণ, উৎপাদন ও মেয়াদ, খাদ্য হস্তান্তর এবং ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কিত জ্ঞান ও ধারণা খাদ্যকে নিরাপদ করে এবং সুস্বাস্থ্য অটুট রাখতে সাহায্য করে। 

 


 খাদ্যাভ্যাস  এবং বিশৃঙ্খলাপূর্ণ খাওয়াঃ      
খাদ্যাভ্যাসের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে অবদান রাখতে পারে খাদ্য সংস্কৃতি। আমাদের খাদ্যে অতিরিক্ত তেল আর চর্বি ব্যবহার করার নিয়মটা অনেক ঐতিহাসিকভাবে পুরনো ।কিন্তু যেকোন মসলা অতিরিক্ত গ্রহন মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর । ধারণা   করা হয় যে খাদ্য শুধুমাত্র দেহের জ্বালানী এবং উপার্জন করা আবশ্যক যা একটি ভুল ধারণা যা বিশৃঙ্খল খাওয়া এবং খাওয়ার ব্যাধি তৈরি করতে পারে। জ্বালানির চেয়ে খাবার অনেক বেশি। এটি আমাদের জীবনের একটি সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অংশ শুধুমাত্র জ্বালানী হিসাবে খাদ্যের উপর ফোকাস করা—অথবা ভাল ব খারাপ —আপনার জীবনের একটি গভীর এবং আরও অর্থপূর্ণ অংশ হিসাবে খাদ্য উপভোগ করা এবং গ্রহণ করা থেকে আপনাকে বিচ্ছিন্ন করে।   


একটি স্বাস্থ্যকর খাদ্য ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং ক্যান্সার সহ সমস্ত ধরণের অপুষ্টির পাশাপাশি অসংক্রামক রোগ (এনসিডি) থেকে রক্ষা করতে সহায়তা করে। অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং শারীরিক কার্যকলাপের অভাব স্বাস্থ্যের জন্য বিশ্বব্যাপী ঝুঁকির দিকে পরিচালিত করে  

 

 

 সবশেষে বলা যায়খাদ্য গ্রহণে আমাদের অনেক বদঅভ্যাস আছে। যেমন যে খাবারটি আমরা বেশি পছন্দ করি তা বেশি খাই সব সময় খাই। খাবার টেবিলে আমাদের খাদ্যে ডাইভারসিটি কম। কিন্তু জরুরি দরকার বেশি সংখ্যক খাদ্যের সমাহার। প্রতিদিন প্রতি বেলায় কিছু শাকসবজি, ফল, আমিষ এসবের সাথে ভাত থাকতে পারে। এসবের প্রতি আইটেম কিছু কিছু খেলে রুচিও বদলাবে সাথে পুষ্টির সমাহারে আমরা উপভোগ করতে পারব। আমাদের আরেকটি ত্রুটি হলো আমার ৩ বেলা বেঁধে খাই। সকাল দুপুর রাত। কিন্তু নিয়ম হলো দিনভর সময় সুযোগ পেলে হালকা কিছু খাবার সব সময় খাওয়া। এতে পুষ্টিশক্তি সুষমতা রক্ষা পায় অনায়াসে। সতেজ বিষমুক্ত পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবারের প্রতি আমাদের যেন বেশি নজর থাকে সে দিকে সতর্কতার সাথে লক্ষ রাখতে হবে। পুষ্টিসম্মত খাবার খেয়ে আমরা পুষ্টিসমৃদ্ধ জাতিতে পরিণত হব এটাই হোক আমাদের নিত্য এবং আন্তরিক ও কার্যকর অঙ্গীকার। 

Back to blog

Leave a comment

Please note, comments need to be approved before they are published.