সুন্দরবনের মাছের খাদ্যগুণ ও উপকারিতা
সুন্দরবনের মাছের খাদ্যগুণ ও উপকারিতা
সুন্দরবন, পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য। ভারত ও বাংলাদেশের অন্তর্গত ১০০০০ বর্গকিমি আয়তনের এই বনে 'জলে কুমীর, ডাঙ্গায় বাঘ'। পাশাপাশি, সুন্দরবন সৃষ্টির শুরু থেকে মৎস্য সম্পদের একটি বড় আধার হিসেবে চিহ্নিত। এখানকার নদ-নদী, খাল ও মোহনাগুলি মৎস্যসম্পদের ভান্ডার। মৎস্যসম্পদ ও মৎস্য প্রজাতি সুন্দরবনের সার্বিক জীববৈচিত্র্যেরও গুরুত্বপূর্ণ অংশ। জোয়ার-ভাটা, স্বাদু-নোনাপানির সঙ্গে সমুদ্রসংলগ্ন নদী হওয়ায় দেশের সবচেয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ মাছ পাওয়া যায় সাতক্ষীরা এবং এর আশপাশের এলাকায়। এসব মাছের অধিকাংশ রাজধানীর বাজার পর্যন্ত আসে না। সেখানকার স্থানীয় ও আশপাশের জেলা-উপজেলার হাটবাজারে বিক্রি হয় এই মাছ। সুন্দরবনের সামগ্রিক মাছের ওপর পূর্বাপর কোনো গবেষণা হয়নি। ফলে মাছের বর্তমান অবস্থা, বিলুপ্ত মাছ, বিলুপ্তপ্রায় মাছের ওপর উপাত্তনির্ভর তথ্য পাওয়া যায় না। শুধু, মানুষ যেসব মাছ খায় এবং যেসব মাছ রপ্তানি উপযোগী, সেসব মাছ চিহ্নিত করা হয়েছে। সুন্দরবনে মৎস্যসম্পদকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। সব মাছ মিলিয়ে হয় সাদা মাছ, বাকিরা বাগদা, গলদা, কাঁকড়া। আশির দশকে চিংড়ির পোনা ধরা শুরু হওয়ার পর মাছের প্রাচুর্য হঠাৎ কমে যায়। আসুন আজকে আমরা সাতক্ষীরা অঞ্চলের সুন্দরবনের মাছ নিয়ে একটা বিস্তর আলোচনা করবঃ
বাগদা চিংড়ি
বাগদা চিংড়ি দশপদবিশিষ্ট চিংড়ি গোত্রীয় প্রাণী। এরা প্রধানত সামুদ্রিক অর্থাৎ লোনা জলের চিংড়ি। বাগদা চিংড়ি আমাদের দেশে একটি পরিচিত মাছ। এটি খেতে সুস্বাদু, দেখতেও সুন্দর। বাংলাদেশে প্রধানত সাতক্ষীরা, কক্সবাজার, টেকনাফ, মহেশখালী, চকরিয়া, খুলনা, বাগেরহাট অঞ্চলে এই মাছের দেখা মেলে বেশি। শুধুমাত্র সুস্বাদু নয়,এতে আছে প্রচুর পরিমানে পুষ্টি উপাদান যা শরীরকে রাখে সুস্থ ও সুন্দর। যেমন-
-
এতে প্রচুর পরিমাণে সেলেনিয়াম যা স্বাস্থ্যের ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি রোধ করে।
-
এতে আছে প্রোটিন,ফ্যাট,এবং মিনারেলসের একটি সুষম অনুপাত যা আমাদের শরীরের পক্ষে অত্যন্ত ভালো। প্রোটিন ফ্যাট, এবং মিনারেলস আমাদের সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
-
হৃৎপিণ্ড ভালো রাখতে সাহায্য করে, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাদ্য। ফ্যাটি অ্যাসিড শরীরের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং এটি লিভারের পক্ষেও ভাল কাজ করে।
-
প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-ই পাওয়া যায় চিংড়িতে। ফলে, পরিমিত পরিমাণ চিংড়ি নিয়মিত খেলে ত্বক ভালো থাকে এবং ত্বকের ঔজ্জ্বল্য দিন দিন বাড়ে।
-
ক্যালসিয়ামের উৎস হিসাবে চিংড়িকে ধরা হয়। আর ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাদ্য আমাদের দাঁত ও হাড় গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা করে।
পারশে মাছ
পারশে মাছের বৈজ্ঞানিক নাম: Chelon subviridis। এটি মুজিলিডি (Mugilidae) পরিবারের অন্তর্ভুক্ত একটি মাছের প্রজাতি। অগভীর উপকূলীয় জলাশয়, ঘেরে , খাড়ি অঞ্চলে এবং প্যারাবনের জলাশয়ে এ মাছ পাওয়া যায়। এটি বাংলাদেশে পাওয়া যায় এরকম একটি লোনা পানির মাছ।দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষের কাছে পারশে যেন এক সুখানুভূতির নাম।কমফোর্ট ফুড যাকে বলে।ভুনা, ভাঁপা,বেগুন দিয়ে মাখা ঝোল-পারশের মিঠে স্বাদ মন ভরিয়ে দেয়।স্বাদু পানির মাছের তুলনায় লোনা পানির মাছ বেশি পুষ্টিকর। এ মাছ উচ্চ প্রোটিনসমৃদ্ধ এবং এতে ক্ষতিকারক চর্বি নেই। যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, দৃষ্টিশক্তি ভালো করে এবং পুষ্টি ঘাটতি দূর করে।
চাকা চিংড়ি
অত্যন্ত সুস্বাদু ও পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ এই চাকা বা সাদা চিংড়ি নদীর একটি মাছ। এটি মাঝারি আকৃতির চিংড়ি। একটি পূর্ণবয়স্ক চিংড়ি ২২ সে.মি.(৯ ইঞ্চি)পর্যন্ত হতে পারে। চাকা চিংড়ি (বৈজ্ঞানিক নাম: Fenneropenaeus indicus, পূর্বে Penaeus indicus) বিশ্বের অন্যতম প্রধান বাণিজ্যিক চিংড়ির একটি প্রজাতি। এটি সাদা চিংড়ি হিসেবেও পরিচিত। এ জাতীয় চিংড়ি, পানির ব্যাপক লবনাক্ততা ও তাপমাত্রার তারতম্য সহ্য করতে অক্ষম। চাকা চিংড়ির পোনা সাতক্ষিরা অঞ্চলের সুন্দরবনের মোহনা , খাল, খাড়ি প্রভৃতি এলাকায় প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। এটা দেখতে যেমন সুন্দর খেতেও তেমন সুস্বাদু। মাছপ্রেমীদের প্রিয় তালিকায় চাকা চিংড়ি অন্যতম। পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ ১০০ গ্রাম চাকা চিংড়িতে রয়েছে ১০৬ মিলি গ্রাম ক্যালরি, ১.৭৩ গ্রাম ফ্যাট, ১৫২ মিলিগ্রাম কোলোস্টোরল, ১৪৮ মিলিগ্রাম সোডিয়াম, ২০.৩ গ্রাম প্রোটিনসহ ০ কার্বোহাইড্রেট। এটি সাধারণত ২০ থেকে ৫০ গ্রাম অব্দি হয়ে থাকে। মাথা ছাড়া প্রতি কেজিতে ৩০ টা থেকে ৭০/৮০ টা পর্যন্ত হতে পারে।
হরিণা চিংড়ি
হরিণা চিংড়ি (বৈজ্ঞানিক নাম: Metapenaeus monoceros) হচ্ছে পেনাইডি (Penaeidae) পরিবারভুক্ত একটি চিংড়ির প্রজাতি। বাংলাদেশে প্রধানত সাতক্ষীরা অঞ্চলে এই মাছের দেখা মেলে বেশি। শুধুমাত্র সুস্বাদু নয়,এতে আছে প্রচুর পরিমানে পুষ্টিউপাদান যা শরীরকে রাখে সুস্থ ও সুন্দর। বৈদেশিক মূদ্রা উপার্জনের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত বাগদা চিংড়ীর বাজার দরের কাছাকাছি অবস্থান নিয়েছে হরিনা চিংড়ি। হরিণা চিংড়ি মধ্যম আকারের চিংড়ি। পুরুষ চিংড়ি ১৫(৫.৯ ইঞ্চি)সেন্টিমিটার এবং স্ত্রী চিংড়ি ২০(৭.৯)সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়।এই চিংড়ি সর্বোচ্চ ১৬০ গ্রাম ওজনের হতে পারে। তবে সাধারণত প্রত্যেকটা চিংড়ির ওজন ৩০ গ্রামের কম হয়ে থাকে।
কোরাল
ভেটকি মাছ এশিয়া অঞ্চলে Sea bass এবং অস্ট্রেলিয়ায় বারামুণ্ডি (ইংরেজি: Barramundi) নামে পরিচিত। বাংলাদেশে এ মাছ কোরাল এবং ভেটকি এই দুই নামে পরিচিত। ভেটকি হচ্ছে হচ্ছে Latidae পরিবারের Lates গণের একটি স্বাদুপানির মাছ।। এর বৈজ্ঞানিক নাম Lates calcarifer. এটি প্রধানত সাতক্ষীরার উপকূলীয় অঞ্চলের নদীতে এবং চিংড়ির ঘেরে পাওয়া যায়। ভেটকিতে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন এ, বি এবং ডি, খনিজ পদার্থ, ক্যালসিয়াম, জিংক, লৌহ, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এবং সিলেনিয়াম থাকে। এগুলো শরীর গঠন ও বৃদ্ধির কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এ মাছে আরো পাওয়া যায় আমিষ, ওমেগা-৩ এবং ওমেগা-৬ ফ্যাটি এসিড থাকে যা আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, হৃদরোগের ঝুঁকি কমায় এবং রক্তের চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে।
দাতিনা
সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলীয় অঞ্চল থেকে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে এ মাছটি। দাতিনা মাছের বৈজ্ঞানিক নাম Pomadasys Hasta, ইংরেজি নাম- Grunter Fish। বাংলাদেশে সাদা, লাল ও স্পটেড জাতের দাতিনা মাছ পাওয়া যায়। তবে সুন্দরবন সংলগ্ন সাতক্ষীরা উপকূলীয় অঞ্চলে সাদা দাতিনা বেশি পাওয়া যায়। দাতিনা মাছ খুবই সুস্বাদু, চাহিদাও প্রচুর। এতে আয়োডিন, ওমেগা ৩ এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদানে ভরপুর যা শিশুদের মস্তিস্ক বিকাশে সহায়তা করে। সামুদ্রীক বা লবনাক্ত পানির মাছ শরীরের রোগ প্রতিরোধ সক্ষমতা বৃদ্ধি করে, হার্টকে কার্যকর রাখতে সহায়তা করে। এছাড়া পারকিনসন, দ্রুত দাত পড়ে যাওয়া, স্মৃতি শক্তি লোপ পাওয়ার মত অনেক রোগ থেকে দূরে রাখে।
খল্লা মাছ
সুন্দরবনের নদী নালাতে, এই মাছের দেখা মেলে। নদীতে এরা ঝাঁকে ঝাঁকে ঘুরে বেড়ায়, তবে কোনভাবে মানুষের উপস্থিতি টের পেলে সঙ্গে সঙ্গে জলে ডুব দেয়। খল্লা মাছ (বৈজ্ঞানিক নাম: Rhinomugil corsula) (ইংরেজি: Corsula mullet) হচ্ছে Mugilidae পরিবারের Rhinomugil গণের একটি মাছ। এই মাছ বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল এবং মায়ানমারের উপকূলীয় অঞ্চলেরনদীতে পাওয়া যায়। এটি শুধুমাত্র সুস্বাদু নয়, এতে আছে প্রচুর পরিমানে পুষ্টিউপাদান যা শরীরকে রাখে সুস্থ ও সুন্দর।
টেংরা মাছ
টেংরা মাছ Bagridae গোত্রের মাংসাশী মাছ। ভারত উপমহাদেশ এদের আদি বাসস্থান। টেংরা মাছ বিশেষ করে নদী, ডোবা, খাল,ও জলাশয় এসব জায়গায় বেশি পাওয়া যায়। টেংরা মাছ আকারে ছোট হয় এবং মাথায় দুই জোড়া গোঁফ থাকে।দেহ প্রায় গোলাকার,দেহে কোনো আঁশ নেই এবং দেহ বেশ পিচ্ছিল।আত্মরক্ষার জন্য ফুলকার দুই পাশে দুইটি এবং পিঠে একটি সরু কাঁটা থাকে।পিঠের উপরের অংশ কালচে এবং পেটের দিকটা সাদা হয়ে থাকে। শুধুমাত্র সুস্বাদু নয়,এতে আছে প্রচুর পরিমানে পুষ্টিউপাদান। যেমন- ১০০ গ্রাম টেংরা মাছে রয়েছে ১৪৪ ক্যালরি শক্তি, ১৯.২ গ্রাম প্রোটিন, ৬.৫ গ্রাম চর্বি, ২৭০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম ও ২ মিলিগ্রাম আয়রন। ১টি টেংরা মাছে আয়রন আছে ২ মিলিগ্রাম। তাই রক্তশূন্যতায় ভোগা রোগীদের ট্যাংরা মাছ খাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়।
মাছের পুষ্টিগুণ অনস্বীকার্য। তাদের উচ্চ-মানের প্রোটিন, ওমেগা -3 ফ্যাটি অ্যাসিড, ভিটামিন এবং খনিজগুলির সাথে, মাছগুলি অগণিত স্বাস্থ্য সুবিধা প্রদান করে থাকে। আপনার ডায়েটে মাছ অন্তর্ভুক্ত করা ভালো কার্ডিওভাসকুলার স্বাস্থ্য, উন্নত মস্তিষ্কের কার্যকারিতা, প্রদাহ হ্রাস এবং সামগ্রিক সুস্থতায় অবদান রাখতে পারে। সুতরাং, মাছকে আপনার খাদ্যের একটি নিয়মিত অংশ করুন এবং সুন্দর স্বাস্থ্য উপভোগ করুন।