চুই ঝাল: উপকারিতা এবং ব্যবহার
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা বাগেরহাট, খুলনা, নড়াইল, যশোর, সাতক্ষীরা এলাকায় জনপ্রিয় একটি ঝাল হলো চুইঝাল। বর্তমানে দেশের অন্যান্য জেলাতেও ঝাল হিসেবে এর জনপ্রিয়তা বাড়ছে।এটি খেতে যেমন সুস্বাদু পাশাপাশি এর রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ঔষধি গুণ। চুইলতার শিকড়, কাণ্ড, পাতা, ফুল- ফল সবই ভেষজ গুণসম্পন্ন। এছাড়াও মসলা হিসেবেও এটি ব্যবহৃত হয়। তবে ঝাল হিসেবে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় হাঁসের মাংস ও গরুর মাংস রান্না করতে।
চুই ঝালের পরিচিতি
চুইঝাল বা চইঝাল লতাজাতীয় এক অমূল্য সম্পদ।চুই ঝাল(বৈজ্ঞানিক নাম: Piper chaba) হচ্ছে পিপারাসি পরিবারের সপুষ্পক লতা। চুই ঝাল গাছ দেখতে পানের লতার মতো। পাতা কিছুটা লম্বা ও পুরু।লতা সুযোগ পেলে ৪০ থেকে ৫০ ফুট পর্যন্ত বাড়ে।যা অন্য গাছের সংস্পর্শে পেঁচিয়ে পরগাছার মতো বেড়ে ওঠে।পাতায় ঝাল নেই।
চুইঝালে রাসায়নিক উপাদান
-পিপালারটিন – ৫ %
-অ্যাকালয়েড-৫%
-সুগন্ধি তেল-৫%
-পোপিরন-৪%-৫%
-এর শিকড়েই পিপারিন রয়েছে -১৩%-১৪ ।
এছাড়া পোলার্টিন, গ্লাইকোসাইডস, মিউসিলেজ, গ্লুকোজ, ফ্রুক্টোজ, সিজামিন, পিপলাসটেরল ইত্যাদি রয়েছে।
চুই ঝালের ব্যবহার
শিকড় বা লতাকে ছোট ছোট টুকরো করে মসলা হিসেবে ব্যবহার করে যেকোনো ধরনের মাংস যেমন:গরুর বা খাসির মাংস রান্না করা হয় যা এ অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী এবং খুবই জনপ্রিয় একটি খাবার।তবে চুই এর শিকড়ের মধ্যে কাণ্ডের তুলনায় কড়া সুঘ্রাণ ও ঝাঁঝালো স্বাদ বেশি থাকার কারণে এটি কাণ্ডের তুলনায় বেশি ব্যবহৃত হয়। চুইঝাল দিয়ে রান্না করলে মাংসে একধরনের কড়া সুঘ্রাণ এবং ঝাল প্রকৃতির, ঝাঁঝালো ও টক স্বাদ যুক্ত হয় যা মাংসের মধ্যে ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের স্বাদ এনে দেয়।
তরকারিতে মরিচের বিকল্প হিসেবে চুইঝালকে ব্যবহার করা যায়, রান্নার পর গলে যাওয়া চুই এর টুকরো চুষে বা চিবিয়ে খাওয়া যায়। বাংলাদেশের দক্ষিণপশ্চিম অঞ্চলের জেলাসমূহ: খুলনা,যশোর,সাতক্ষীরা,বাগেরহাট এবং নড়াইল এলাকায় এই চুইঝালের মাংস খুব জনপ্রিয়। চুইঝাল দিয়ে মাংস রান্না ব্যাপক পরিমাণে জনপ্রিয় হলেও চুইঝাল দিয়ে মাছ কিংবা অন্যান্য তরকারি রান্না এবং বিভিন্ন ধরনের ভর্তা বা আচার তৈরিতেও ব্যবহার করা হয়।
চুইঝালের উপকারিতা
চুইঝাল খাবারের স্বাদ বৃদ্ধির পাশাপাশি চুইঝালের আছে নানাবিধ ওষুধি গুন। যা শরীরকে সুস্থ রাখতে নানাভাবে সাহায্য করে। যেমন-
-গ্যাস্ট্রিক সমস্যার সমাধান করে;
-কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে;
-খাবারের রুচি বাড়ায় এবং ক্ষুধামন্দা দূর করে;
-ক্যানসার প্রতিরোধে সহায়ক ভুূমিকা পালন করে;
-হৃদ্রোগ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে;
-পাকস্থলী ও অন্ত্রের প্রদাহ সারাতে চুইঝাল অনেক উপকারী;
-কাশি, কফ, হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়া ও রক্তস্বল্পতা দূর করে;
-সদ্য প্রসূতি মায়েদের শরীরের ব্যথা দ্রুত কমাতে ম্যাজিকের মতো সাহায্য করে;
-অ্যাজমা ও ব্রংকাইটিস রোগ প্রতিরোধে সহায়ক ভুূমিকা পালন করে;
-শারীরিক দুর্বলতা কাটাতে সাহায্য করে।
চুইঝালের অর্থনৈতিক গুরুত্ব
বাংলাদেশে চুইঝালের চাষের বিস্তার ঘটিয়ে হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব। এ ছাড়া এটি দেশের বাইরেও রপ্তানি করা সম্ভব। এরই মধ্যে খুলনার চুই দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে বাইরেও রপ্তানি হচ্ছে। এ ছাড়া নার্সারি শিল্পে চুইঝাল একটি মূল্যবান লাভজনক উপকরণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে এখন।খুলনার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক মো. মোছাদ্দেক হোসেন বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব সম্পর্কে দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘এ অঞ্চলে চুইঝালের চাষ আগে থেকে হলেও বর্তমানে এর আবাদ আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। যেমন- ২০১৯-২০ অর্থবছরে পুরো জেলায় মাত্র ৩০ হেক্টর জমিতে চুই চাষ হতো। সে বছর এখন পর্যন্ত প্রায় ১০৩ হেক্টর জমিতে দেশীয় চাষ হচ্ছে। মাত্র তিন বছরে চাষের সংখ্যা তিন গুণ হওয়ার কারণ হলো এটি বেশ লাভজনক। চুই চাষ লাভজনক হওয়ার বেশ কিছু কারণও রয়েছে। সেগুলো হলো- চুই চাষের জন্য আলাদা কোনো জমি লাগে না, গাছের জন্য তেমন কোনো পরিচর্যা লাগে না, সার ও কীটনাশক ব্যবহার করতে হয় না। এ ছাড়া চুইঝাল যেহেতু লতাজাতীয় তাই এর জন্য আম, কাঁঠাল, জাম, সুপারি, নারিকেল, মেহগনি গাছ আরোহণের সাপোর্ট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যারা বিভিন্ন ধরনের ফলের বাগান করে থাকেন তারা চুইকে সাথি ফসল হিসেবে চাষ করেন। সব মিলিয়ে এর চাষ খরচ একেবারেই নামমাত্র। আর খরচের তুলনায় এটির বাজারমূল্য বেশি হওয়ার কারণে কৃষকরা যথেষ্ট লাভবান হয়ে থাকেন।
এটি নিঃসন্দেহে বলা যায় যে মরিচের বিকল্প হিসেবে চুইঝালের জনপ্রিয়তা বাড়লে দেশের হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। একই সাথে ভেষজ গুণ থাকার কারণে অনেক রোগব্যাধির আক্রমন থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।