মৌমাছি কি গণিতবিদ?
মৌমাছি ও ষড়ভুজঃ একটি বৈজ্ঞানিক প্রেম কাহিনী
মৌমাছি কি গণিতবিদ?
মৌমাছিরা তাদের কাজের নীতি , অসাধারণ মধু সংগ্রহ ও তাদের শক্তিশালী সামাজিক বন্ধনের মাধ্যমে শতাব্দী ধরে মানুষকে বিমোহিত করে আসছে। যাইহোক এই ক্ষুদ্র প্রাণীগুলোর আরেকটি দিক রয়েছে তা প্রায়শই অলক্ষিত থেকে যায়। আর তা হল তাদের অসাধারণ গাণিতিক দক্ষতা। বিজ্ঞানীরা দাবি করেছেন মৌমাছির গাণিতিক কোন হিসাব করার দক্ষতা আছে। এমনকি এই ক্ষুদ্র প্রাণীটি পৃথিবীর বক্রতা গণনা করারও ক্ষমতা রাখে। এটুকু পড়ার পরেই আমাদের মাথায় প্রশ্ন আসে- আমরা তাদের এই গাণিতিক দক্ষতা কোথায় দেখতে-উত্তরটি তাদের মৌচাকের উদ্ভাবনী স্থাপত্যের নকশার মধ্যেই রয়েছে।
মৌমাছি কি স্থাপত্যশিল্পী?
মৌচাক শুধুমাত্র মৌমাছির বাসস্থান নয়; এটি তাদের অস্তিত্বের যোগান দেয় । মানুষের মতো মৌমাছিদেরও বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য ও বাসস্থানের প্রয়োজন হয় । তারা এই উভয় চাহিদাকে মাথায় রেখে সুনিপুনভাবে মৌচাক তৈরি করে। আপনি যদি ভালোভাবে একটি মধুচক্র/মৌচাক খেয়াল করেন তাহলে আপনি একটি নিখুঁত ও আকর্ষণীয় ছয়-পার্শ্বযুক্ত প্যাটার্ন দেখতে পাবেন। যা অবিকল ষড়ভুজ আকৃতির। কেন মৌমাছিরা অন্য সব সম্ভাব্য ডিজাইন রেখে এই ডিজাইন বেছে নিয়েছে? আসুন মৌমাছির জগতে খোঁজকরি এবং আবিষ্কার করি কেন তারা তাদের মৌচাকের কাঠামোগত ভিত্তি হিসেবে ষড়ভুজ আকৃতি বেছে নেয়।
ষড়ভুজ আকৃতি বেছে নেয়ার পেছনের কারণগুলো বোঝার জন্য আমাদের কিছুটা মৌমাছির মতো করে ভাবতে হবে। বেঁচে থাকা নিশ্চিত করতে, মৌমাছিদের তাদের মৌচাকের নকশা নিখুঁত করতে হবে,কারণ মৌমাছিদের মধু সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপদ স্থানের প্রয়োজন, নাহলে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন মৌমাছির চ্যালেঞ্জ
যাইহোক তাদের পরবর্তী চ্যালেঞ্জ ছিল তারা কি দিয়ে তাদের মধুচক্র/মৌচাক তৈরি করবে । Because Bees don’t have beaks or arms to pick up things । তাই তারা সিদ্ধান্ত নেয় তাদের যেহেতু মোম তৈরি করার ক্ষমতা আছে সেহেতু তারা মোম দিয়েই তাদের মধুচক্র তৈরি করবে। এবং পাশাপাশি এমন একটা শেপ তৈরি করতে হবে যাতে অল্প জায়গায় বেশি মধু সংরক্ষণ করা যায়।
কিন্তু শেপটির আকৃতি কেমন হবে?
প্রাথমিকভাবে, মৌমাছিরা বিভিন্ন আকার যেমন বৃত্ত,ত্রিভুজ,বর্গক্ষেত্র এবং এমনকি পঞ্চভুজ নিয়েও পরীক্ষা নিরীক্ষা করে। এবং সবধরণের গণনা, ট্রায়াল এবং ত্রুটি পরীক্ষা শেষে তারা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যে হেক্সাগন বা ষড়ভুজ হচ্ছে সবথেকে কার্যকর শেপ। কারণ হেক্সাগন বা ষড়ভুজ আকৃতির সেলে একমাত্র অল্প জায়গায় বেশি মধু সংরক্ষণ করা যায়। এবং অন্য শেপ এর তুলনায় কম শ্রম ও সময় লাগে। যার ফলে মৌমাছি বেশি মধু ও মোম তৈরির সময় পায়।
কেন ষড়ভুজ আকৃতি?
আপনি কি এখনো ভাবছেন কেন এই আকৃতি? আচ্ছা, মৌমাছিরা তাদের মধুচক্র/মৌচাকে ষড়ভুজ তৈরি করার কারণগুলো নিচে দেওয়া হলঃ
দক্ষতা:ষড়ভুজ আকৃতি হচ্ছে গাণিতিক জগতে সবচেয়ে কার্যকর আকৃতিগুলোর মাঝে একটি । ষড়ভুজ সেল ব্যবহার করে মধুচক্র/মৌচাক তৈরি করলে মৌচাকের পরিধি কমে যায়। যার অর্থ বৃত্ত,ত্রিভুজ,বর্গক্ষেত্র এবং পঞ্চভুজ আকারের তুলনায় কম মোম ব্যবহার করে বেশি মধু সংগ্রহ করতে পারে।
শক্তি: ষড়ভুজ অন্যান্য আকারের তুলনায় বৃহত্তর কাঠামোগত স্থিতিশীলতা প্রদান করে। ষড়ভুজ সেলগুলোতে তিন-পার্শ্ব থেকে একে অপরের সাথে আটকে থাকে , যা তাদের শক্তিশালী করে তোলে এবং মধু বা মৌমাছির লার্ভার ওজনে ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা হ্রাস করে ।
শক্তি দক্ষতা: মৌমাছিরা মৌচাক নির্মাণের সময় তাপ উৎপন্ন করে এবং ষড়ভুজ আকৃতি পুরো মৌচাক জুড়ে সমানভাবে এই তাপ বিতরণ করতে সাহায্য করে। শীতকালে বেঁচে থাকার জন্য এই দক্ষ তাপ বিতরণ পদ্ধতি অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে ।
টিকে থাকার ক্ষমতা: মৌচাক নির্মাণে ষড়ভুজ ব্যবহারকে বিবর্তনের ফল বলে মনে করা হয়। বংশ পরম্পরায়, মৌমাছিরা যারা ষড়ভুজ কোষ তৈরি করে তাদের নিজস্ব সম্পদের ব্যবহার এবং পৃথিবীতে বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে একটি আলাদা সুবিধা পায় বলে ধারনা করা হয়।
ধারাবাহিকতা: মৌমাছিরা তাদের মৌচাক নির্মাণে ষড়ভুজ আকার ব্যবহার করে জিনিসগুলিকে মজবুত এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখতে। যখন তারা মৌচাক তৈরি করা শুরু করে, তখন তারা উপরে-নিচ দিক থেকে ছোট মোমের কোষ তৈরি করে। ষড়ভুজ আকৃতি নিশ্চিত করে যে সমস্ত কোষগুলি একে অপারের সাথে তিন দিক থেকেই পুরোপুরি আটকে থাকে। কোষের এই অভিন্ন বিন্যাসের ফলে একটি মসৃণ এবং নির্বিঘ্ন মৌচাক গঠন হয়। এবং ফলস্বরূপ তারা বেশি পরিমাণে মধু সংগ্রহ করতে পারে।
সবশেষে বলা যায়, ষড়ভুজের প্রতি মৌমাছির ভালোবাসা নিছক সুযোগ বা নান্দনিক পছন্দ নয়। এটি তাদের গাণিতিক দক্ষতার ও বৈজ্ঞানিক প্রতিভার প্রমাণ। এই ক্ষুদ্র প্রাণীগুলো আজ অবধি বিজ্ঞানী এবং প্রকৌশলীদের অনুপ্রাণিত করে চলেছে, এটি প্রদর্শন করে যে কখনো কখনো, জটিল সমস্যার সবচেয়ে মার্জিত এবং কার্যকর সমাধানগুলি প্রকৃতির নিজস্ব বাড়ির উঠোনেই পাওয়া যায়।
পরেরবার যখন আপনি এক চামচ মধু উপভোগ করবেন,ছোট্ট মৌমাছির দ্বারা নির্ভুল ও যত্নসহকারে তৈরি সুস্বাদু খাবারের পেছনে গাণিতিক ও বৈজ্ঞানিক প্রতিভার প্রশংসা করার জন্য কিছুক্ষণ সময় নিন।